সংসারে অভাব তাই লেখাপড়া না করে ঘোড়ার গাড়ী চালাচ্ছি। এই গাড়ী চালিয়ে যা পাই তাতে সংসারের কিছুটা হলেও উপকার হয়। কথাগুলো বলেছিলেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানির ইউনিয়নের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র নাজমুল।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ঘাটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ব্রহ্মপুত্র নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানি শুন্যতায় বিশাল এলাকা জুড়ে ধু ধু বালুর চর থাকে। পানি কমে যাওয়ায় কামারজানি বাজার থেকে নদীর ঘাটের দুরুত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। এই বালু পথে মানুষ হেটে গিয়ে নৌকায় উঠে তাদের গন্তব্য স্থানে যাওয়ার জন্য। তবে এই ঘাট হয়ে বিভিন্ন চরে প্রতিদিন ১০-১৫ হাজার মানুষ চলাচল করে। কমবেশি সকলের হাতে ছোট-বড় বস্তা বা ভারি মালামাল থাকে।
নৌকার যাত্রীদের ঘাট থেকে নৌকা পর্যন্ত ও নৌকা থেকে ঘাট পর্যন্ত ভারি মালামাল বা বস্তা পরিবহনের জন্য ঘোড়ার গাড়ী ব্যবহার হয়। চরের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মালামাল নিয়ে যাওয়া আসা করা খুবই কষ্ট কর হয়। কারণ বালুচরের মধ্যে একমাত্র ঘোড়ার গাড়ী ছাড়া আর অন্যকোন গাড়ী দিয়ে মালামাল বহন করা সম্বভ হয় না বা চিন্তাও করা যায় না। প্রতিদিন প্রায় ২৫-৩০টি ঘোড়ার গাড়ী এই কাজে ব্যস্ত থাকে। চরাঞ্চলের একমাত্র উৎকৃষ্ট বাহন এই ঘোড়ার গাড়ী।
ঘোড়া দৌড়ের টং টং শব্দ কানে এলে ঘুরে দেখা যায় কামারজনি ঘাট থেকে ঘোড়ার গাড়ীতে করে বেশ কিছু মালামালের বস্তা বোঝাই করে নৌকার উদ্দেশ্যে ছুটে আসছে একটি ছোট ছেলে। পরে কথা বলে জানা যায় ছেলেটির নাম নাজমুল মিয়া। এতো অল্প বয়সে গাড়ী চালাচ্ছো কেন? কোন ক্লাশে লেখাপাড়া কর? জানতে চাইলে নাজমুল বলে আগে লেখাপড়া করতাম এখন বাদ দিছি। সকাল করে মোক্তবে পড়ি। সে কামরজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেনি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। অভাবের কারণে স্কুলে বাদ দিয়ে সকালে মসজিদে মোক্তব পড়ে সারাদিন বাবার সাথে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে পরিবারকে সাহায্য করে সে।
নাজমুলের বাবা কায়সার মিয়া বলেন, নদী হামার থাকার জাগা কোনা কারি নিছে। বর্তমানে হামরা সরকারি জাগাত বাড়ি করি বউ-ছোল নিয়ে আছি। আয় রোজগারের একমাত্র পথ একটি ঘোড়ার গাড়ী। এই গাড়ী চালিয়ে কোন রকমে চলে সংসার। ব্রহ্মপুুত্র নদীর ভায়াল গ্রাসে বসতবাড়ী হারানো আর অভাবের কারণে ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলেকে লেখাপড়া করাতে পারেনি। তাই মেজো ছেলেকে লেখাপাড়া করানোর চেষ্টা করছি। আর ছোট ছেলেটা সবে মাত্র হাটতে শিখছে। বড় ছেলেটা ঢাকায় কাজ করে। আর মেজো ছেলে সংসারের অভাবের কারণে লেখাপড়ার পাশাপাশি ওই ঘোড়ার গাড়ী চালিয়ে সাহায্য করে আমাকে।
অনেক ইচ্ছে সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো কিন্তু অভাবের কারনে পারছি না। নদী ভাঙ্গনের কারণে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে সরকারি জায়গায় কোনমতে একটা ঘর তুলে আছি। আয়ের তেমন কোন উৎস নাই। এই অভাবি সংসারের মাঝে সন্তানদের কিভাবে লেখাপড়ার খরচ চালাই। একটি ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে কোন রকমে দিনাপাতিত করছি।
বর্তমানে শীতের কারণে ঘোড়ীর গাড়ীতে কী প্রভাব পড়েছে আগের চেয়ে এখন আয় কম না বেশি জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রচন্ড শীতের কারণে মানুষ ঘর থেকেই বেড় হতে পারে না আয় হয় কিভাবে। শীত, কুয়াশা, বাতাশের কারণে ঘাটে মানুষের চলাচল অনেকটাই কমে গেছে তাই আমাদের আয়ও অনেকটা কম।
বর্তমানে নদীতে পানি কম থাকার কারণে গাইবান্ধা জেলার নদী বেষ্টিত চার উপজেলার ১শ’ ২০টি চরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের যাতায়াত ও কৃষি পণ্যসহ প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। চরাঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে এ অঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে আর তা হচ্ছে চরে যাতায়াতে পাও, না হয় নাও। অর্থাৎ বর্ষায় নৌকা আর শুকনো মৌসুমে পায়ে হাটা। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন।
শুকনো মৌসুমে যাতায়াতের দুর্ভোগ লাঘবে ব্যবহৃত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ী। এক ঘোড়া দিয়ে ছোট ছোট মোটরের টায়ারের চাকায় চলে এসব গাড়ী। চরের বালুর উপর দিয়ে ওই গাড়ীগুলো দিব্যি চলতে পারে। প্রতিটি গাড়ীতে ১৬ থেকে ২০ মণ পণ্য পরিবহন করা যায়। এছাড়া চালকসহ ৫ থেকে ৬ জন যাত্রী বালু চর পারি দিয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। বালু চর ছাড়াও এসব ঘোড়ার গাড়ীতে মেইন ল্যান্ডে এবং উপজেলা পর্যায়ের সড়কেও মালামাল পরিবহন করা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে পাকা সড়কে ৩০ মণ পণ্য দ্রব্য টানা সম্ভব বলেও জানালেন ঘোড়ার গাড়ীর চালকরা।
আর একটি সুবিধা হলো এসব ঘোড়ার দামও বেশি নয়। একটি ঘোড়া মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। তবে ঘোড়া এ জেলায় পাওয়া যায় না। কিনে আনতে হয় দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রামের খড়িবাড়ী এবং টাঙ্গাইলের তুলসিপুর হাট থেকে। সেখানে গরু ছাগলের হাটের মত ঘোড়ার হাটও বসে। প্রতিদিন একটি ঘোড়ার গাড়ী থেকে ২৫০শত থেকে ৫শত টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এর মধ্যে ঘোড়ার খাবার বাবদ ব্যয় হয় ২০০শত টাকা। তবে বর্ষা মৌসুমে চরে নৌকা চলে বলে তাদের আয় কমে যায়। ইদানিং ঘোড়ার গাড়ীর প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চলের মানুষের কষ্ট কিছুটা হলেও কমেছে।
সামাজিক উন্নয়ন পদক্ষেপ এসইউপি নির্বাহী পরিচালক এম সাদ্দাম হোসেন পবন বলেন, শিশুর মানুষিকতা শিক্ষার দিকে স্থির করতে অভিবাবকদের ভূমিকা রাখতে হবে। কামারজানী বন্দরে শিশু শ্রম বাড়ার এক মাত্র কারন পিতার ঘোড়ার গাড়ী প্রথমে শখে আকৃষ্ট করে। পরে সেখান থেকে ফিরে এসে শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করতে চায় না। ফলে এ ভাবেই শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ছে বন্দরে কাজ করা শিশুরা।
No comments:
Post a Comment