আমার বাঁশখালী.কম:
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন নিজ দেশের বাইরে ‘স্বৈরশাসক’ হিসেবেই পরিচিত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং তাদের মিত্র দেশগুলোর কাছে কিম জং উন রীতিমত বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি স্বরুপ। পশ্চিমাদের সাথে কিমেরও বেশ সাপে নেউলে সম্পর্ক। সেই কিমই এখন হাত মেলাতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে।
বিগত কয়েক বছর ধরে উত্তর কোরিয়া তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে বেশ শক্ত অবস্থানে ছিল। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের কড়া চাহনি উপেক্ষা করে পরীক্ষা চালাতে থাকে একের পর এক শক্তিশালী দূর পাল্লার মিসাইলের। কিন্তু ধারণা করা হয় যে, জাতিসংঘ এবং মার্কিন প্রশাসনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য অবরোধের মুখে বেশ বিপাকে পরে দেশটি।
তবে চীন এবং ইরানের সহায়তায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম তাও চালিয়ে নিচ্ছিল পিয়ং ইয়ং। চীন তাদের সবথেকে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার আর খোদ ইরানের কাছে পারমাণবিক পণ্য বিক্রি করছিল উত্তর কোরিয়া।
তবে গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়া শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার অংশ নেওয়ার পর থেকেই দুই কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও বৈঠকে বসতে যাচ্ছে তারা।
শুধু তাই নয়, কোন রকম পূর্ব শর্ত ছাড়াই নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে সম্মতি দেওয়ারও ইঙ্গিত দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে বৈঠকে বসতে কিমকেই বেশি উৎসাহী হতে দেখা গেছে।
বিশ্ব গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ট্রাম্প ছাড়াও অন্যান্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথেও সাক্ষাতের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কিম। আগামী সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে উনের সাথে কিমের সরাসরি দ্বিপক্ষীয় সাক্ষাতের কথা রয়েছে। এ বৈঠকে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। পাশাপাশি এই বৈঠকে ট্রাম্পের সাথে কিমের বৈঠক নিয়েও আলোচনা হবে। গত সপ্তাহে সিআইএ পরিচালক মাইক পম্পে উত্তর কোরিয়া গিয়ে দেশটির শীর্ষ নেতা কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
কেন কিমের এই নরম অবস্থান?
চলতি বছরের শনিবার সব ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা বাতিল করেন কিম জং উন। এছাড়াও সবধরনের পারমানবিক কর্মসূচি বন্ধের পাশাপাশি স্থাপনাগুলোও বন্ধের আদেশ দেন তিনি। প্রশ্ন হচ্ছে কিম হঠাত করে এত নরম অবস্থান কেন নিলেন?
অনেকেই মনে করছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলোকে টক্কর দেওয়ার মত সামরিক শক্তি অর্জন করেছে পিয়ং ইয়ং। বিশেষ করে কিম ভাবছেন যে, যে পরিমাণ পারমাণবিক ক্ষেপনাস্ত্র এখন তাদের আছে তার থেকে বেশি আর তাদের দরকার নাই বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
এর পাশাপাশি নিজেদের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ উঠিয়ে নিতেও এতটা নরম অবস্থানে এসেছেন কিম।
কিম জং উন শনিবার সব ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বাতিলের পাশাপাশি একটি পারমাণবিক কর্মসূচি স্থাপনা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। শনিবার থেকেই পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা ও আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা বন্ধ করে দেশটি। কোরিয়া উপদ্বীপে শান্তি স্থাপনে ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত শুক্রবার দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বসেন কিম জং উন। এই সময় কিম বলেন, আর কোনো ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বা পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন তিনি। নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি নতুন বছরের শুরুতে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, এটি তারই প্রতিফলন। ছয়টি পারমাণবিক পরীক্ষার পর উত্তর কোরিয়ার মনে হয়েছে, বর্তমানের চেয়ে সামনে এগুনোর আর কোনো দরকার নেই। আবার নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল এড়ানোর কৌশল কিনা তা নিয়েও সন্দেহ দানা বাঁধছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।
ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্ট-এর সদস্য এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অঙ্কিত পাণ্ডার মতে, উত্তর কোরিয়ার ইতিহাস এবং তার ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করলে উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। এর কারণ হিসাবে পাণ্ডা বলছেন, প্রথমত- পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধের যুক্তি হিসাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের যে কথা প্রেসিডেন্ট কিম দাবি করেছেন, সেটা একবারে অবিশ্বাস করার মত নয়।
ভারত ও পাকিস্তানের উদাহরণ টেনে পাণ্ডা বলেন, ১৯৯৮ পর্যন্ত এই দুই দেশের প্রত্যেকে ছয়টি করে পারমাণবিক পরীক্ষার পর তারা আর কোনো পরীক্ষা করেনি এবং সারা বিশ্ব মেনে নিয়েছে এরা পারমাণবিক শক্তিধর। ছয়টি পারমাণবিক পরীক্ষার পর উত্তর কোরিয়া একইভাবে নিশ্চিত হয়েছে তারা অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। পাণ্ডার মতে, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার পঞ্চম এবং ষষ্ট পারমাণবিক পরীক্ষায় দাবি করে তারা যে কোনো পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ছোড়া যায় এমন আকারের এবং ওজনের পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ধারণা করা হয়, ঐ বোমার ক্ষমতা নাগাসাকিতে আমেরিকার ফেলা বোমার চেয়ে তিনগুণ শক্তিধর।
গত বছর পরীক্ষা করা বোমার শক্তি আরো অনেক বেশি। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর পরীক্ষার পর ভূকম্পন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীদের ধারনা হয়েছে উত্তর কোরিয়া এখন যে কোনো শহর ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তার পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণায় বোঝা যাচ্ছে কিম এখন নতুন আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছেন।
আরেকটি দিক হতে পারে যে, অর্থনৈতিক অবরোধে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে উত্তর কোরিয়া।
নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, গত ফেব্রুয়ারির এক রাতে কয়েকটি ট্রাক দেশটির সীমান্তে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অনেক শ্রমিক চীন থেকে চোরাই পথে আসা বিভিন্ন পণ্য বোঝাই করছে। কিন্তু সীমান্তে নজরদারি থাকায় সেটা সম্পূর্ণ করতে পারছে না। পরে ভোরবেলায় ট্রাকগুলো বিভিন্ন পণ্য বোঝাই করে নিয়ে চলে যেতে দেখা যায়। দেশটিতে শ্রমিকদের এ দশা নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এর আগে কয়েকবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু তাতে তেমন একটা ফল আসেনি।
গত সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘ কড়া নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করে। উত্তর কোরিয়ার কয়লা, লৌহ, সামুদ্রিক খাবার এবং পোশাক খাতের রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এটা পুরোদমে কার্যকর হলে রপ্তানির ৯০ ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। এরপর ডিসেম্বরে পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় জাতিসংঘ। বছরে ৫ লাখ ব্যারেলের বেশি পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানি করা যাবে না। ফলে এর আগের বছরের চেয়ে ৯০ ভাগ আমদানি কমে যায়।
উত্তর কোরিয়া বাইরের দেশে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে তার ৯০ ভাগের বেশি করে চীনে। গত বছরই সেটা এক-তৃতীয়াংশে গিয়ে পৌঁছে। গত বছরেই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি পৌঁছেছে ১৬৮ কোটি ডলারে।
তবে এতকিছুর মধ্যেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় বসতে উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছে ইরান। জাতিসংঘের এক অধিবেশনে অংশ নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ জাভাদ জারিফ গতকাল এমন মন্তব্য করেন। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন ধরনের চুক্তির যোগ্য নয় উল্লেখ করে উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক অবস্থান থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সূত্রঃ নিউ ইয়র্ক টাইমস
No comments:
Post a Comment