![]() |
আমার বাঁশখালী ডেক্স:
বাঁশখালীর সমুদ্র উপকূল থেকে এ বছর ৮০০ কোটি টাকার ইলিশ এবং বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ দেশ-বিদেশে গেছে। অথচ সরকার রাজস্ব পায়নি এক টাকাও। সরকারের রাজস্ব আদায়ের কোনো ব্যবস্থাও নেই । দুই সহস্রাধিক ছোট-বড় মাছ ব্যবসায়ী, জেলে ও ফিশিং বোটের মালিক একাট্টা হয়ে নানা কৌশলে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা। এছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর, বাণিজ্যিক নৌ অধিদপ্তর, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন ও মৎস্যজীবীদের জোরালো সমন্বয়ের অভাব এবং দায়সারা ভাবের কারণে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের বিপুল টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাচ্ছে না। কর্মকর্তারা জনবল সংকটে সমন্বয়টা জোরালো করা যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেছেন। এমনকি মৎস্য সম্পদ আহরণ করে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাওয়া অসংখ্য মৎসজীবী আয়করও দিচ্ছেন না।
বাঁশখালীর শেখেরখীল ফাঁড়ির মুখ, সরকার বাজার, ছনুয়া-কুতুবদিয়া ঘাট, বাহারছড়া, খানখানাবাদ উপকূলে সরেজমিন ঘুরে, ইলিশ ও বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ চালানে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুমভিত্তিক দৈনিক ১০ থেকে ২০ কোটি টাকার সামুদ্রিক মাছ চালান দেওয়ার নজির আছে। অথচ এসব মাছ সংরক্ষণ ও চালানের জন্য সরকারি তদারককারী কোনো সংস্থা বাঁশখালীতে নেই। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা থাকলেও নানান সীমাবদ্ধতায় তাঁকে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। এমনকি কী পরিমাণ ফিশিং বোট বা বরফ কলের লাইসেন্স আছে বা নেই তাও আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা নেই তাঁর। পর্যবেক্ষণ, প্রতিবেদন প্রদান, পোনা নিধন বন্ধ ও জেলে সংখ্যা নিরুপণ করার ব্যাপারে সচেতনতামূলক উদ্বুদ্ধ করে তোলার মধ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কোনোরূপ শাস্তি কিংবা অন্যায় প্রতিরোধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের শরণাপন্ন হতে হয়। তাতেও নানা ভোগান্তির অন্ত নেই। আরো দেখা গেছে, বাঁশখালী থেকে সামুদ্রিক মাছ চালান দিতে বরফ ব্যবহারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাস জায়গার উপর ২৪টি বরফ কল স্থাপন করা হয়েছে। বরফ কলগুলোর অধিকাংশের যাবতীয় লাইসেন্স নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইজারাবিহীন খাস জায়গা রাজস্ব ছাড়া ব্যবহার করছে। এসব বরফ কলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে প্রতিদিন বাঁশখালীবাসী ভয়াবহ লোডশেডিংয়েরও শিকার হয়। বরফ কলগুলোও দৈনিক ১৫/২০ লাখ টাকার বরফ বিক্রি করে। সাগর থেকে ইলিশ আহরণ ও বহন কাজে নিয়োজিত আনুমানিক ২ হাজার ফিশিং বোটের অধিকাংশের লাইসেন্স নেই। এছাড়া এসব ইলিশ মাছ বিক্রি করে এলাকায় কোটিপতি হওয়া ব্যক্তিদের বিশাল বিশাল অট্টালিকা থাকলেও তাঁরা সরকারকে আয়কর ও ভ্যাট দিচ্ছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কোটিপতি আয়কর ও ভ্যাট কী তারা অবগত নন বলে জানান। তবে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, গভীর সমুদ্র থেকে এসব মাছ আহরণ করতে গিয়ে সন্ত্রাসী ও জলদস্যুদের তাঁরা চাঁদা দেন নিয়মিত। নচেৎ প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে।
বাঁশখালী উপকূলের জেলে, ফিশিং বোটের মালিক ও মাঝি-মাল্লাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ও বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ চালান দেয় হয় অন্তত ৮০০ কোটি টাকার। সরকারি হিসাবে ৫০০ কোটি টাকা। চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন প্রজনন মৌসুমের কারণে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। এর পর আরো প্রচুর ইলিশ মাছ আহরিত হবে। তবে বাঁশখালী থেকে ইলিশ বিক্রয়ে জড়িত সিন্ডিকেট সামুদ্রিক মাছ বিক্রয়ের সঠিক তথ্য দেয় না বলে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
বাঁশখালী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘মৎস্য অধিদপ্তর, বাণিজ্যিক নৌ অধিদপ্তর, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন ও মৎস্যজীবীদের জোরালো সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বিশাল সমুদ্রে তদারকি করার জন্য মৎস্য অফিসের ব্যক্তিগত জলযান না থাকায় যাবতীয় বিষয় তদন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সুচারুভাবে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় সব কিছু আড়ালে থেকে যাচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা কৌশলে মাছের আড়ত না করে খোলা বাজার দেখিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ চালান দিচ্ছেন। আড়ত হলে রাজস্ব আদায় করা যেত। এছাড়া ২৪টি বরফ ফ্যাক্টরি ও ২ হাজার ফিশিং বোটের অধিকাংশের যাবতীয় লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স করার নোটিশ দিলেও সবাই একাট্টা হয়ে লাইসেন্স করে না। এই খাতে রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারি শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। কেননা কোনোরূপ রাজস্ব না দিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে প্রভাবশালী মহল। এই খাতে সরকার রাজস্ব আদায় করলে এই টাকা জেলেদের বিভিন্ন কর্মমুখী খাতে ব্যবহার করা যেত।’
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মমিনুল হক বলেন, ‘মৎস্য সম্পদকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে প্রাধান্য দিলে দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে। এজন্য মৎস্য সম্পদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর জোরালো সমন্বয় ও সহযোগিতা জরুরি। জেলেরা মৎস্য আহরণ করতে গিয়ে জলদস্যুদের তাণ্ডবে পড়ে নানামুখি চাঁদাবাজি ও হয়রানি শিকার হয়। অপরদিকে জেলে, ফিশিং বোটের মালিক ও মাছ ব্যবসায়ীরাও সরকারকে উপযুক্ত রাজস্ব দিচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও তাত্ক্ষণিক সহযোগিতা পাওয়া যায় না। মৎস্য বিভাগের জন্য আলাদা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকা প্রয়োজন।’
মেরিনের সহকারী পরিচালক অধীর চন্দ্র দাশ বলেন, ‘আমরা ফিশিং বোটের যা তালিকাভুক্ত করেছি তাতে ৪০ শতাংশ লাইসেন্স নেই। জনবল সংকটের কারণে ফিশিং বোটের সঠিক তালিকাও নিরুপণ করা যাচ্ছে না। দ্রুত সঠিক তালিকা নিরুপণ ও লাইসেন্স প্রস্তুত করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ জন্য একটা কমিটিও গঠন করা হয়েছে।’
কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের অপারেশন অফিসার লেফটেনেন্ট কমান্ডার আলাউদ্দিন বলেন, ‘সাগরে আমাদের নিয়মিত টহল জাহাজ আছে। জলদস্যুদের দমন করা আমাদের কাজ। ফিশিং বোটের মালিক কিংবা জেলেদের কাছ থেকে খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমরা অ্যাকশানে যাই। ফিশিং বোটে লাইসেন্স না থাকার কারণে জেলেরা জলদস্যুদের খপ্পরে পড়লেও আমাদের কাছে খবর পৌঁছায় না। কারণ অবৈধ ফিশিং বোটের বিরুদ্ধেও আমরা অ্যাকশানে যাই। এসব কারণে অপরাধ ঘটছে।’
বাঁশখালীর শেখেরখীল ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি এয়ার আলী বলেন, ‘জলদস্যুদের নিয়মিত টোকেনের মাধ্যমে চাঁদা দিয়ে ফিশিং বোট চালু রাখতে হয়েছে। চাঁদা না দিলে জলদস্যুরা ফিশিং বোট ডুবিয়ে দেয় নয়তো বোট থেকে মাছ, জাল ও ইঞ্জিন লুট করে নিয়ে যায়। কয়েকদফা ফোন করেও নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের দ্রুত সহযোগিতা পাওয়া যায় না।’
ফিশিং বোটের মালিক ও জেলে মো. ইসমাইল বলেন, ‘আমরা ফিশিং বোটের মাধ্যমে জীবনবাজী রেখে সাগর থেকে মাছ আহরণ করি। আমার বোটের যাবতীয় লাইসেন্স আছে এর পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হই। কোথাও কোনো অভিযোগ করলে উল্টো আরও বেশি ক্ষতির শিকার হই। যেন মদ, গাঁজার ব্যবসা করছি। আমাদেরকে নীতিমালা প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়া হোক তা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। সরকারি রাজস্ব না দিলেও তার দ্বিগুণ টাকা আমরা অন্যায় করছি বলে বিভিন্ন দপ্তর কেড়ে নিচ্ছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাস জায়গার উপর ইজারা না নিয়ে ২৪টি বরফ কল স্থাপন করা হয়েছে। শত শত ফিশিং বোট বেড়িবাঁধের উপর নোঙর করে সামুদ্রিক মাছ চালান দিচ্ছে এবং সংরক্ষণ করছে। বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। অথচ ইজারা নিয়ে এসব কাজ করার নোটিশ জারি করলেও জেলে, মাছ ব্যবসায়ী ও ফিশিং বোটের মালিক কেউ কথা শুনে না। ফলে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছি।’
বাঁশখালীর কাথারিয়া ইউনিয়নের পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, ‘বাঁশখালীর সমুদ্র উপকূল থেকে কোটি কোটি টাকার সামুদ্রিক মৎস্য চালান দেওয়া হচ্ছে। এসব খাতে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হলে ওই রাজস্ব দিয়েই বাঁশখালীর বহুমুখী উন্নয়ন সম্ভব হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে জানা গেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়। এর মধ্যে এর ৬০ শতাংশই আহরিত হয় বাংলাদেশে। ফলে মোট মৎস্য উৎপাদনের এককভাবে ইলিশের অবদানই প্রায় ১১ শতাংশ।
গত কয়েক বছর ধরে দেশে ৩ থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন ওঠানামা করছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি টাকার ইলিশ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউরোপ আমেরিকার রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের ইলিশের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন ও পরিকল্পনার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করে মৎস্যজীবীদের কল্যাণে অর্থ বিনিয়োগ জরুরি। কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ কোটিপতি ও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মৎস্যসম্পদ আহরণে অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকলে মৎস্যসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার বাঁশখালী ডটকম। সূত্র: কালেরকণ্ঠ।






No comments:
Post a Comment