আমার বাঁশখালী ডেস্ক:
রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মানুষ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে) অন্যের কাছে বলে বেড়ায়।’ (সিলসিলাতুস সহিহাহ)। সংবাদ পরিবেশনে সতর্কতার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেনÑ ‘হে মোমিনরা! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে তোমরা তা যাচাই-বাছাই করো; যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হতে হয়।’ (সূরা হুজুরাত : ৬)
সাংবাদিকতা বর্তমানে তথ্যপ্রবাহ ও তথ্যায়নের যুগে সর্বাধিক প্রচলিত ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও পেশার নাম। বর্তমান পৃথিবীর এমন কোনো কাজ নেই যা ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক যাই হোক না কেন তা কোনো সংবাদ নয়। প্রতিটি ঘটে যাওয়া ঘটনা বা কাজ তা প্রচারিত হোক বা না হোক তা সংবাদ। এত ঘটনার মধ্যে জীবনের অবিচ্ছেদ্য ঘটনা সংবাদ আকারে সবার সামনে যিনি উপস্থাপন করেন তিনিই সাংবাদিক। আর এ পেশাকেই বলা হয় সাংবাদিকতা। শাব্দিক অর্থে সাংবাদিকতা শব্দটি এসেছে সংবাদ থেকে; যার ইংরেজি প্রতি শব্দ হলো ঘবিং এবং আরবি প্রতি শব্দ হলো খবর, হাদিস, কিসসা বা নাবা। এই নাবা থেকেই নবী। নবী শব্দের অর্থ সংবাদদাতা, সংবাদ বাহক, দূত ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনে নাবা শব্দের যথেষ্ট ব্যবহার রয়েছে। এমনকি একটি সুরার নামও রয়েছে আন নাবা বা সংবাদ। মানুষের প্রতিটি কাজকেই পবিত্র কোরআনে সংবাদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামের সর্বশেষ নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) এর যত বাণী রয়েছে সেগুলোকে খবর বা সংবাদ বলা হয়েছে। তিনি সাহাবিদের উপদেশ দিতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছেনÑ ‘আমি কি তোমাদের এমন সংবাদ দেব না যার ওপর আমল করলে তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে?’
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রতিটি কাজের হিসাব নেবেন বলে আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। সাংবাদিকতা এর বাইরে নয়। তথ্য প্রচার ও প্রসারে একজন সাংবাদিকের কাজকে যদি নবী-রাসুল ও ফেরেশতাদের কাজের সঙ্গে উপমা দেওয়ার মতো সুযোগ থাকে তাহলে সংবাদ সংগ্রহ, আদান-প্রদান, সম্পাদনা ও প্রচারের ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিককে কতটা বিশুদ্ধ জ্ঞান, মন-মগজের অধিকারী হওয়া ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেহেতু মানুষের প্রতিটি কথা, কাজ ও ঘটে যাওয়া সবকিছু সংবাদ ও প্রচারের বিষয়বস্তু এবং মানুষের জান-মাল, সম্মানসহ অন্যান্য বিষয়, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও নাগরিক অধিকারের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর সঙ্গে জড়িত তাই সংবাদ প্রচার ও প্রকাশে বস্তুনিষ্ঠতার পাশাপাশি জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতাও রয়েছে বহুগুণে। সেটা ইহকালে হোক আর পরকালে হোক। কারণ, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর প্রত্যেককেই তার কাজের জন্য জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
একজন সাংবাদিক যেহেতু দেশ ও দশের অবস্থা সবার সামনে তুলে ধরেন তাই তাকে অনেক বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ তিনি যা করছেন তা নিছক সাংবাদিকতাই নয়; তার কাজের ধর্মীয় মূল্যায়নও রয়েছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ সাংবাদিক ও জনগণ হলো মুসলিম। এ পেশায় এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয় যা অন্য পেশায় কম। তাই সতর্কতাও একটু বেশি প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দেশীয় নিয়ম-কানুনের পাশাপাশি একজন সাংবাদিকের ইসলামের দিকনির্দেশনা গুরুত্বের সঙ্গে এবং স্বচ্ছভাবে জানা থাকা উচিত। আমাদের নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) তাঁর থেকে তথ্য প্রচারে সতর্কতার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আমার থেকে একটি মাত্র বাণী হলেও প্রচার করো। আর বনি ইসরাইলের ঘটনা বর্ণনা করো তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যারোপ করবে সে যেন জাহান্নামে তার জায়গা ঠিক করে নেয়।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
এ অর্থে আরও অনেক সতর্কবাণী রয়েছে। ইসলামের মূলনীতি হলো কোনো কাজের শাস্তি যদি জাহান্নাম বলা হয় সে কাজ করা হারাম এবং তা থেকে বেঁচে থাকা ওয়াজিব। তাছাড়া অন্যের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে রাসুল (সা.) বলেন, ‘একজন মুসলমানের ওপর আরেকজন মুসলমানের তিনটি জিনিস হারাম করা হয়েছে। ১. জীবন অর্থাৎ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা যাবে না, ২. সম্পদ অর্থাৎ কারও সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা যাবে না, ৩. সম্মান অর্থাৎ কারও সম্মানহানি করা যাবে না।’ (তিরমিজি)।
ইসলামে মিথ্যাকে হারাম এবং সব অপরাধের জননী বলা হয়েছে। এমন তথ্য গোপন করা যাবে না, যাতে কারও অধিকার নষ্ট হয়। অন্যের গিবত (কারও মাঝে বিদ্যমান দোষ) প্রকাশ করা ইসলাম হারাম করেছে। তবে সাংবাদিকরা যেসব বিষয়ের সমালোচনামূলক সংবাদ পরিবেশন করতে পারবেন তা হলোÑ ১. কারও বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ও প্রামাণ্য অভিযোগÑ যাতে অন্যের বৈধ হক জড়িত। ২. ধর্মীয় ফতোয়া প্রচারÑ যদিও তাতে অন্যের অপরাদের কথা উল্লেখ থাকে। ৩. সতর্কীকরণ সংবাদ অর্থাৎ কেউ জালেম, দুর্নীতিবাজ, সুদখোর, ঘুষখোর বা অন্য কোনো উপায়ে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র বা সর্বসাধারণের জন্য প্রমাণিত ক্ষতিকর তাদের ব্যাপারে সতর্কতামূলক সংবাদ প্রচার করা। তবে এ ক্ষেত্রে কেউ যদি দ-প্রাপ্ত ও তওবা করে থাকে তার বিষয় আলাদা। ৪. কেউ যদি অপরাধ স্বীকার করে সে অপরাধের সংবাদ প্রচার করা। ৫. কোনো ব্যক্তি, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা দলের পরিচয় যদি নিন্দনীয় হয়Ñ তা অবিকৃত প্রচার করা। একটি সংবাদ কখোনোই গুজবের ভিত্তিতে হতে পারে না এবং তা হতে পারে না কাউকে ধোঁকা, প্রতারণা বা বিভ্রান্ত করার জন্য।
আর তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে তথ্যের বিকৃতি, মিথ্যা, ষড়যন্ত্র বা উদ্দেশ্যমূলক বা হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ ধরনের সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির জন্য যেমন নিষিদ্ধ তেমনি ইসলামেও হারাম বা নিষিদ্ধ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মানুষ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে) অন্যের কাছে বলে বেড়ায়।’ (সিলসিলাতুস সহিহাহ)। সংবাদ পরিবেশনে সতর্কতার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেনÑ ‘হে মোমিনরা! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে তোমরা তা যাচাই-বাছাই করো; যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হতে হয়।’ (সূরা হুজুরাত : ৬)।
এ আয়াত প্রমাণ করে কোনো সংবাদই নির্বিচার প্রচার করা যায় না। কারণ, ওই সংবাদের ভিত্তিতে কেউ না আবার অজ্ঞতাবশত ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। আজ একজন সংবাদকর্মীর সহযোগিতায় বহুরূপী তথ্য সংবাদে ওঠে আসে।
এ তথ্যের ভিত্তিতে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অনেক সন্ত্রাসী, অপরাধী এবং অনৈতিক কর্মকা- আইনের আওতায় আসে; দুর্নীতি দমনে, অপরাধ কমিয়ে আনার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার সুরক্ষায়ও ব্যাপক ভূমিকা রাখে সাংবাদিকতা। আবার রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উত্তেজনা, অশ্লীলতাসহ অনেক অপ্রীতিকর সংবাদ ও ছবি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সংবাদের ফলেই। অশ্লীলতা নিয়ন্ত্রণে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা চায় মোমিনদের মাঝে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়–ক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদয়ক শাস্তি; আল্লাহ জানেন তোমরা জানো না।’ (সূরা নূর : ১৯)।
তথ্য মিডিয়াকে যে কোনো দেশের দর্পণ বলা হয়। কোনো দর্পণ যদি অস্বচ্ছ, উল্টো, প্রতারণামূলক বা বিকৃত হয়Ñ নিশ্চয়ই তা কেউ গ্রহণ করবে না। পরিশেষে বলব, সাংবাদিকতায় যেহেতু শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মানুষদের নিয়ে কাজ করে তাই সংবাদের সঙ্গে জড়িত সব কর্মীকে সুশিক্ষিত, মেধাবী, সুপ-িত, আইন ও অধিকারের বিষয়ে সচেতন সর্বোপরি ধর্মীয় বিষয়ে অঢেল জ্ঞান থাকতে হবে। তবেই একটি মুসলিম দেশের সাংবাদিক হিসেবে এ পেশার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে এবং এ পেশায় নিয়োজিত একজন সংবাদকর্মী নিছক কাজ করা নয় বরং কাজটি পরিণত হয় ইবাদতে এবং ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের উত্তম প্রতিদানের পাথেয়। এর ব্যতিক্রম হলেই একজন সংবাদকর্মী হয়ে যাবেন দুনিয়া ও আখেরাতে একজন ক্ষতিকর প্রাণী। আল্লাহর কাছে কামনা করি যিনিই সাংবাদিকতায় যুক্ত আছেন ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে ইবাদতের আদলে কাজ করে দেশ ও জাতির সেবা করে পরকালে অগণিত পুণ্য অর্জন করতে পারেন ইনশাআল্লাহ।
No comments:
Post a Comment