আমার বাঁশখালী.কম.ডেক্স রিপোর্টার মোঃ রোবেল
সতর্কতার সঙ্গে বাঁশের সেতু পার হচ্ছিলেন ১৭ বছর বয়সী দেবযানি দাস; ফিরছিলেন এক প্রতিবেশীর কুঁড়েঘর থেকে। গায়ের চাদরটি দিয়ে অদ্ভুতভাবে পেছনে ঝুলিয়ে রেখেছেন ১৩ মাস বয়সী কন্যাকে। একটু এদিক-ওদিক হলেই সোজা পানিতে গিয়ে পড়বেন। সে সম্ভাবনা হয়তো কম। কারণ এতে তিনি অভ্যস্ত। কাদা ও পানি মাড়িয়ে বন্যার পানিতে ঘিরে থাকা বাড়িতে ফিরে দেখেন, সেটিকে ঠিকঠাক করছেন তার ১৯ বছর বয়সী স্বামী ‘চিত্র’। ঘরের চালায় অসংখ্য ফুটো। ততক্ষণে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। চার বছর আগে বর্ষার এক দিনে এই বাড়িতে বঁধু হয়ে এসেছিলেন দেবযানি। সেটি ছিল ২০০৮ সালের প্রবল বন্যার সময়কার ঘটনা। তার পরিবার তখন শরণার্থী শিবিরে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বলতে কিছুই ছিল না। বিশেষ কিছু বলতে মেঘলা রঙের একটি সিল্কের চাদর পরেছিলেন, তাও ধার করা। সেই থেকে দেবযানির ঠিকানা আসামের ধেমজি জেলার বোথা দই গ্রাম। বিয়ের পরেও দেবযানির উপাধিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তার স্বামীও দলিত দাস সম্প্রদায়েরই লোক।
ভারতে অপ্রাপ্তবয়স্ক দম্পতির সংখ্যা অসংখ্য, তবে এ সমস্যার তীব্রতা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে অন্যান্য অনেক রাজ্যের চেয়ে বেশি। সেখানকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি একটি সাধারণ ঘটনা। নিম্নাঞ্চল ও বন্যাকবল অঞ্চলগুলোয় ঘটছে সবচে’ বেশি। আর এ ধরনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কনের বয়স থাকে বিয়ের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত। আসামে নিযুক্ত ইউনিসেফ-এর শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রকাশ গৌতমের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, এ রাজ্যে লিঙ্গ বৈষম্য ও দারিদ্র্যের পাশাপাশি বন্যা ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত অল্প বয়সে বিয়ের জন্য মূলত দায়ী। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র বাল্যবিবাহ বন্ধে খুব একটা তত্পর নয়। প্রশাসনের কানে খবর গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখেও না দেখার ভান করে।
ভারতে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ আর ছেলেদের ২১। কিন্তু ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে নির্ধারিত বয়সে পা রাখার আগেই। এ হার আসামে আরও বেশি। জরিমানা আরোপ, শিক্ষা এবং সচেতনতা কর্মসূচি চালু থাকা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহকে প্রত্যাশিত মাত্রায় কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। দেবযানি কোনও ব্যতিক্রম নন। গাঁটছড়া বাঁধার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১১। সে সময় তার বাবা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে ধান ক্ষেতে কাজ করতেন। গৃহপরিচারিকা হিসেবে মার ঠিকানা হয়েছিল গুয়াহাটি। সেখানে তার বড় ভাই এক হোটেলে টেবিল পরিষ্কারের কাজ করত। বাড়ির সবচে’ বয়স্ক মেয়ে হওয়ায় গৃহস্থালীর সব কাজ সামলাতে হতো দেবযানিকে। কিন্তু বন্যা সবকিছুকেই ওলট-পালট করে দেয়। বাড়িঘর ভাসিয়ে নেওয়ায় সবাই গিয়ে উঠেছিলেন ত্রাণ শিবিরে। খবর পেয়ে মা-ও এসে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে। গুয়াহাটিতে বড় ভাইয়ের পরিচয় হয় চিত্র’র সঙ্গে। কথায় কথায় সে দেবযানিকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। পরে উভয় পরিবারই তাতে আপত্তি তোলেনি। বিলম্বে বিয়ে ভেঙে যেতে পারে সে চিন্তা থেকে ত্রাণ শিবিরেই চার হাত একত্র করার আয়োজন করা হয়েছিল।
বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে দেবযানি বলছিলেন, ‘বাবা-মা খাওয়ার একটি মুখ কমিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। সে চিন্তা থেকেই তারা আমাকে দ্রুত বিদায় করেছিলেন। আমিও প্রতিবাদ করতে পরিনি। আসলে আমাদের মতো মেয়েরা প্রতিবাদ করতে পারে না। ভেবেছিলাম, স্বামীর সংসারে আমার তেমন কাজ করতে হবে না। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তব ভিন্ন বিষয়। এখানে আরও বেশি কাজ করতে হয় আমাকে। রান্নাবান্না, কাপড় ও ঘরদোর পরিষ্কার, ধান ভানা, পানি ও রান্নার কাঠ সংগ্রহ এবং ছাগল পোষা— আগের মতোই এ সব কিছু করতে হয় আমাকে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুই সন্তানের লালন-পালন। আমার স্বামী শুধু আয়ের দিকটি দেখে। অন্য বিষয়গুলো দেখার সময়ও নেই তার হাতে।’
চিত্র’র দুই বোনের পরিণতিও ঘটেছে দেবযানির মতো। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তাদের বিয়ে হয়ে যায়। তাদের বাবা রিকশাচালক। একার আয় দিয়ে সকলের ভরণ-পোষণে অপারগ ছিলেন তিনি। ছেলেকে তাড়াহুড়া করে বিয়ে করিয়েছিলেন ওই চিন্তা থেকে যে, ঘরে বউ আসলে আয়-রোজগারের দিকে মনোযোগী হবে। এতে অবশ্য কিছুটা কাজও হয়। দেবযানি গর্ভবতী হওয়ার পরই চিত্র হোটেলে কাজ করার জন্য চলে গিয়েছিল মুম্বাইয়ে। এখন কাজ করে কেরালার একটি কারখানায়, আসামের তুলনায় সেখানে মজুরি চার গুণ বেশি।
ভারত সরকার বাল্যবিবাহ নিষেধাজ্ঞা আইন পাস করে ২০০৬ সালে। তা সত্ত্বেও হরহামেশা ঘটছে বাল্যবিবাহ। জন্মনিবন্ধন না থাকায় সবাইকে আইনের আওতায় আনাও যাচ্ছে না। আসামসহ সব রাজ্যেই অধিকাংশ শিশুর জন্ম হয় বাড়িতে। অভিভাবকরা তাদের জন্মনিবন্ধনের প্রয়োজন মনে করে না। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সংগঠন ধেমজি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেবজ্যোতি দত্ত জানিয়েছেন, আসামের গ্রামাঞ্চলে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের ১৬ শতাংশ এরই মধ্যে মা হয়েছে এবং ৩০ শতাংশই অশিক্ষিত। এসব স্থানে লক্ষণ দেখে ছেলে-মেয়ের বয়স আন্দাজ করা হয়, যেমন— কোন ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া মানে তার বয়স ১৩ কিংবা ১৪। সবেমাত্র গোঁফ গজানোর অর্থ বয়স হয়েছে ষোল। একজন মেয়ের বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছার মানে বিয়ের জন্য যোগ্য হয়ে গেছে সে। প্রকৃত বয়স অপ্রাসঙ্গিক। মেয়েদের বয়স যত বাড়ে সতীত্ব হারানোর সম্ভাবনা ততই বেড়ে যায় আসামে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে মেয়েকে দ্রুত পরের ঘরে চালান করে দিতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন অনেকে।
No comments:
Post a Comment